ইমাম হুসাইনের (আ.) চল্লিাশা অনুষ্ঠানে আশুরা বিপ্লবের চৌম্বকীয় আকর্ষণ

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, হুসাইনের প্রতি মু’মিনের হৃদয়ে ভালোবাসার যে উত্তাপ রয়েছে তা কখনও প্রশমিত হবে না। হ্যাঁ, মহানবীর সেই ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবতা দিনকে দিন প্রোজ্জ্বল হচ্ছে। সুদূর নাইজেরিয়া থেকে জাকার্তায় ও সব ক’টি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে প্রেমের এই উত্তাপ।

সফর মাসের ২০ তারিখে কারবালায় ঘটি থাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ। যত অশ্রু ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের স্মরণে যুগ যুগ ধরে বিসর্জিত হয়েছে ও হবে তত বড় অশ্রু-সাগর আরও কখনও সৃষ্টি হবে না অন্য কারও জন্য। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের চেহলাম বার্ষিকী তথা চল্লিশা বা আরবাঈন হচ্ছে এমন একদিন যেদিনে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হুসাইনি আন্দোলনের স্মৃতি অমরত্ব লাভ করে। তার মতে কারবালার ঘটনার পর বেঁচে থাকা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র বংশধররা যদি আশুরার স্মৃতি ও এর প্রভাবকে টিকিয়ে রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম না করতেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে শাহাদত ও আশুরা বিপ্লবের সাফল্যগুলোকে ব্যাপক মাত্রায় কাজে লাগানোর তেমন একটা সুযোগ থাকত না।

হযরত যয়নব (সা.আ) ও ইমাম সাজ্জাদ কারবালার প্রকৃত ঘটনা কুফা, সিরিয়া ও মদিনায় তুলে ধরেছিলেন এবং আশুরা বিপ্লবের আসল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য তুলে ধরেছিলেন বলেই এই মহান বিপ্লব তথা খাঁটি ইসলাম আজও জীবন্ত ও প্রোজ্জ্বল হয়ে টিকে আছে বলে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী মনে করেন। হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, কেউ যদি আশুরার ঘটনার বিষয়ে এক পঙক্তি কবিতা বলেন ও এর ফলে কেউ কেঁদে ফেলেন তাহলে তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব হয়ে যায়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে এই ঘোষণার ব্যাপক প্রচারের দরকার ছিল।  কারণ ক্ষমতাসীন উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী আশুরা ও কারবালার ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল। তারা বিশ্বনবীর (সা.) আহলে বাইতের নাম ও মর্যাদাকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিল জনগণের মন থেকে। ইমাম হুসাইনের শাহাদতের চেহলাম পালন ও আশুরার শোক গাঁথা বর্ণনার প্রচলন না থাকলে উমাইয়াদের সেই ষড়যন্ত্র অনেকাংশেই সফল হত বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন।

ইমাম হুসাইনের (আ.) চল্লিাশা অনুষ্ঠান ইসলামের শত্রুদের প্রচারণার ঝড়ের মোকাবেলায় কারবালার শহীদদের শাহাদতের স্মৃতি ও বাস্তবতাকে চির-জাগ্রত করে রেখেছে বলে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মনে করেন। তাই আশুরার সংস্কৃতির প্রসার ও প্রচারের জন্য আরবাঈন পালন অত্যন্ত জরুরি। আরবাঈন আজ বিশ্বের মুক্তিকামী ও সংগ্রামী মানুষদের ঐক্যের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি শিয়া ও সুন্নি মুসলমান আজ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন পবিত্র কারবালায়। অনেকেই শত শত মাইল পায়ে হেঁটে স্মরণ করছেন কারবালার সেই ঐতিহাসিক কাফেলার মহাযাত্রাকে এবং নবী-পরিবারের বন্দি সদস্যদেরকে শত শত মাইল পথ পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইমাম হুসাইনের চেহলাম বার্ষিকীর পদযাত্রাকে নজিরবিহীন এবং প্রেম ও ইমানে ভরপুর সফর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, হায় যারা আরবাঈন উপলক্ষে পায়ে হেঁটে কারবালায় যাচ্ছেন তাদের মতই যদি সৌভাগ্যবান হতে পারতাম!

আরবাঈনের সংস্কৃতির গোড়া প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারতের জন্য কারবালায় বিশ্বনবীর বিশিষ্ট সাহাবি জাবির বিন আবদুল্লাহ আনসারি (রা.)’র সেই ঐতিহাসিক সফরের ঘটনা। ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাতের পর তাঁর পবিত্র কবর প্রথম জিয়ারত করেছিলেন জাবের বিন আবদুল্লাহ আনসারি (রা.) ও আতিয়ে কুফি। ইমামের শাহাদাতের চল্লিশ দিন পর জাবের মদিনা থেকে পায়ে হেঁটে কারবালায় পৌঁছেন। অতি বৃদ্ধ ও দৃষ্টি-শক্তিহীন জাবের (রা)  কারবালায় পৌঁছে ফোরাতের পানিতে গোসল করে ও লম্বা পোশাক পরে গায়ে সুগন্ধি মাখেন। এরপর মহান আল্লাহর জিকির করতে করতে ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র কবরের পাশে পৌঁছেন। তিনি সঙ্গী আতিয়েকে বললেন, আমার হাত হুসাইনের কবরের ওপর রাখ। আতিয়ে তা করার পরই তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন। আতিয়ে জাবের (রা.)’র মাথায় পানির ছিটা দেয়ার পর তাঁর হুঁশ ফিরে আসে। হুঁশ ফেরার পর তিনি তিন বার দুঃখ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন: হুসাইন! হুসাইন! হুসাইন! এক পর্যায়ে তিনি বলেন:  ‘হুসাইন! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি শ্রেষ্ঠ ও মহান মু’মিনদের এবং হেদায়াত ও খোদাভীতির পথিকৃতের সন্তান। তুমি কাসা ও আবার তথা রাসূল (সা.)’র চাদর এবং আলখাল্লার নীচে স্থান পাওয়া ৫ সদস্যের মধ্যে পঞ্চম। তুমি মহান আমিরুল মু’মিনিনের এবং ফাতিমা জাহরা (সা.)’র সন্তান। আর কেনই বা এমনটি হবে না, কারণ, রাসূলগণের সর্দার সাইয়্যেদুল মুরসালিন নিজ হাতে তোমাকে খাবার খাইয়েছেন এবং তুমি পরহিজগারদের কোলে বড় হয়েছ। মু’মিনের বুকের দুধ পান করেছ ও পবিত্র জীবন যাপন করেছ এবং পবিত্র থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছ; আর মুমিনদের হৃদয়গুলোকে তোমার বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে শোকাহত করেছ। তাই তোমার প্রতি সালাম এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি তোমার ওপর বর্ষিত হোক। তুমি সে পথেই গিয়েছ যে পথে গিয়ে তোমার ভাই হযরত জাকারিয়া ইবনে ইয়াহিয়া নবী (আ.) শহীদ হয়েছিলেন।’

রাসূল (সা.)’র সাহাবি হযরত জাবের (রা.) আরও বলেন: ‚সালাম তোমাদের আত্মার প্রতি যারা হুসাইনের পাশে (শহীদ হয়ে) সমাহিত হয়েছ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তোমরা নামাজ কায়েম করেছিলে ও জাকাত আদায় করেছিলে এবং সৎ কাজের আদেশ দিতে ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে। তোমরা কাফিরদের সঙ্গে জিহাদ করেছিলে এবং আমৃত্যু খোদার ইবাদত করে গেছ। তিনি আরো বলেন: আমি সেই আল্লাহর কসম দিচ্ছি যিনি রাসূল (সা.)-কে ন্যায্যত রাসূল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তোমরা শহীদরা যে কষ্ট ও মুসিবতের শিকার হয়েছ আমরা তার শরিক।

ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম হুসাইন (রা.)’র কর্তিত শির মুবারক তাঁর শাহাদতের পর চল্লিশতম দিনে সিরিয়া থেকে কারবালায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং তা ইমামের পবিত্র শরীরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এর আগে ইমাম জয়নুল আবেদিন অলৌকিকভাবে কুফার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ইমাম হুসাইন (রা.) সহ কারবালার অন্যান্য শহীদদের লাশ দাফন করেছিলেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিতে ইমাম হুসাইনের (আ.) চল্লিাশা অনুষ্ঠান আশুরা বিপ্লবের চৌম্বকীয় আকর্ষণের সূচনা ছিল মাত্র। এ আকর্ষণ বৃদ্ধ সাহাবি জাবিরকে মদিনা থেকে নিয়ে যায় কারবালায়। আর বর্তমান যুগে দুই কোটিরও বেশি আহলে-বাইত প্রেমিক প্রাণনাশের হুমকি সত্ত্বেও কারবালায় সমবেত হয় সেই একই আকর্ষণে। অনেক অমুসলিম ইমাম হুসাইনের অনন্য অবদান ও তাঁর প্রতি কারবালাগামী মানুষের গভীর ভালোবাসা দেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। #

সূত্র: পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/১৬